Today: ডিসে ২২, ২০২৪
Live

আ’লীগের কেন্দ্রীয় ৭৭ নেতার মধ্যে গ্রেফতার ৯, বাকিরা পলাতক

1 week ago

( রিপোর্টটি ওয়েবসাইটের সংস্কার কাজের জন্য বনিক বার্তা থেকে নেওয়া হয়েছে )

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পরিধি ৮১ সদস্য হলেও ২২তম জাতীয় সম্মেলনে তিনটি পদ ফাঁকা রেখে ৭৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা হয়। তাদের মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী কিছুদিন আগে মারা গেছেন। গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে দলটির বাকি কেন্দ্রীয় নেতাদের সিংহভাগই আত্মগোপনে যান। কেবল নয় কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।

তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা চলমান। আর দলটির সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আত্মগোপনে আছেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের সভাপতিমণ্ডলীর ১৭ সদস্যের মধ্যে এ পর্যন্ত ছয়জন গ্রেফতার হয়েছেন। তারা হলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, কাজী জাফর উল্যাহ, মো. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, শাজাহান খান ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। এছাড়া চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন কেবল ডা. দীপু মনি। আট সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি আছেন শুধু আহমদ হোসেন। আর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ।

কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে প্রথম গ্রেফতার হন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সরকারের পররাষ্ট্র ও শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর বারিধারা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০ আগস্ট রাতে গ্রেফতার হন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। রাজধানীর বনশ্রী থেকে তাকে আটক করা হয়। পরদিন পল্টনের মুদি দোকানদার নবীন তালুকদার হত্যার অভিযোগে করা মামলায় তাকে চারদিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। এরপর আরো কয়েকটি মামলায় কয়েক দফা রিমান্ড শেষে বর্তমানে কারাগারে আছেন তিনি।

আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং মাদারীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপকে ২৫ আগস্ট আটক করে পুলিশ। রাজধানীর ১২/১ পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসা থেকে আটক করার পর আদাবরে পোশাক শ্রমিক রুবেল হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ঢাকায় ও মাদারীপুরে রিমান্ড শেষে বর্তমানে তিনি মাদারীপুর কারাগারে রয়েছেন। আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে ৬ সেপ্টেম্বর সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা ও মাদারীপুরে কয়েক দফা রিমান্ড শেষে বর্তমানে তাকে মাদারীপুর কারাগারে রাখা হয়েছে। মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন এ শ্রমিক নেতা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারের কথা জানায় পুলিশ। আগের রাতে রাজধানীর গুলশান থেকে পল্টন থানার একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানানো হয়। গ্রেফতারের পর ডিবি কার্যালয়ে নেয়ার পর অসুস্থ বোধ করলে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখনো তিনি হাসপাতালেই আছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।”

সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাককে গত ১৪ অক্টোবর রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকা থেকে আটক করা হয়। পরদিন নিউমার্কেট থানায় করা ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে দুদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এরপর কয়েক দফায় রিমান্ড শেষে বর্তমানে তিনি টাঙ্গাইলের কারাগারে রয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খানকে গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে গ্রেফতারের তথ্য জানানো হয়। পরে পল্টন থানায় করা আরেকটি মামলায় তাকে দুদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রাজধানীর ধানমন্ডিতে শামীম নামের এক কিশোরকে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় সর্বশেষ গত রোববার ফারুক খানের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

সাবেক পূর্তমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে গত ২৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। পরে তাকে আদালতে হাজির করা হলে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াদুর রহমান কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর পল্টনে বিএনপি কর্মী মকবুল নিহতের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।

রাজধানীর উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর থেকে গত ১৮ নভেম্বর রাতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন তাকে আটদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিউমার্কেট থানাধীন নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশের গুলিতে ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ মারা যাওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কামরুল ইসলাম গ্রেফতার হন। পরবর্তী সময়ে ৯ ডিসেম্বর কামরাঙ্গীরচর থানার চাঁদাবাজির দুই মামলায় সাবেক এ মন্ত্রীকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর আত্মগোপনে চলে গেছেন আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারাও। সে তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় গ্রেফতারও হচ্ছেন।

শেখ হাসিনা সরকারের কোনো মন্ত্রীকে গ্রেফতারের খবর প্রথম আসে ১৩ আগস্ট। সেদিন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে আটকের কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ। পরে তাদের এক হকার নিহতের ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় করা হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু; সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে পল্টন থানার মামলায় ১৪ আগস্ট গ্রেফতারের খবর জানায় ডিএমপি। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ আগস্ট রাতে ঠাকুরগাঁওয়ের বাড়ি থেকে সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনকে আটক করে পুলিশ। তাকেও একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এছাড়া ২৯ আগস্ট সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও ৩ অক্টোবর সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের গ্রেফতারের তথ্য পাওয়া যায়।

হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে সাবেক নৌ-প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দাবি করেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের ভুয়া মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কাউকে গ্রেফতার করে মামলা দেয়ার আগেই তার রায় নির্ধারণ করা হচ্ছে। দেশে আইনের কোনো শাসন নেই, আইন বলতে কিছুই নেই। অবৈধ সরকার যেসব কার্যক্রম চালাচ্ছে, সেগুলোরও কোনো বৈধতা নেই। প্রত্যেককে ভুয়া মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না।’

সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতার করা হয় ১৬ আগস্ট। তিনি টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক ছিলেন। সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হককে যে হত্যার মামলায় গ্রেফতার করা হয়, জিয়াউল আহসানকেও সে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের অনেক নেতকর্মী, সাবেক এমপি-মন্ত্রী জনরোষ থেকে বাঁচতে বিদেশ পালিয়ে যান। এর মধ্যে বেশির ভাগই প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে কলকাতার একটি পার্কে বসে থাকতে দেখা যায়। সৌদি আরবের নগরী মক্কায় দেখা গেছে শামীম ওসমানকে। এছাড়া আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় আরো কিছু নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা গেছে। অন্যান্য দেশে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা গেছে কারো কারো ক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রীদের মধ্যে ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মাহবুব-উল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের অবস্থান নিয়েও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে অজ্ঞাত স্থান থেকে মাঝেমধ্যেই দলীয় বিবৃতি দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম। এছাড়া কেউ কেউ হোয়াটসঅ্যাপ বা অনলাইনে সাক্ষাৎকারও দিচ্ছেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। তবে তারা কেউই নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আক্রোশের বশবর্তী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সময় কারো সবসময়ই একই রকম থাকে না। যেমন এ মুহূর্তে সময় আমাদের অনুকূলে নেই।’