(ওয়েব সাইটের সংস্কার কাজের জন্য প্রতিবেদনটি দৈনিক বনিক বার্তা থেকে নেওয়া হয়েছে )
হাজং বিদ্রোহ ও তেভাগাসহ গত শতকের বড় বড় কৃষক আন্দোলন ও বিদ্রোহগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে কমরেড মণি সিংহের নাম চলে আসবে অবধারিতভাবেই। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের অন্যতম তিনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জেলও খেটেছিলেন। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরও বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন তিনি। এমনকি পার্টি নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায়ও আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেও দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ও প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা রেখেছেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন।
এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ ফরহাদ। তিনি উঠে এসেছিলেন ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মস্তিষ্ক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। দীর্ঘদিন দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
মণি সিংহ এবং মোহাম্মদ ফরহাদের পর সিপিবির আর কোনো নেতা বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারেননি। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও দলটির প্রভাব দিনে দিনে কমেছে। যদিও এ দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করা হয় সিপিবিকেই।
পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশ ঘটে গত শতকের ত্রিশের দশকে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) হাত ধরে। দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে (কোনো কোনো সূত্রমতে ১৯২০ সালে)। ত্রিশের দশক ও এর পরবর্তী সময়ের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনগুলোয় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছিলেন কমিউনিস্টরা। ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ প্রতিষ্ঠিত সিপিবি ওই দলেরই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করছে। পাকিস্তান আমলে দলটির কার্যক্রম ছিল মূলত পূর্ব বাংলাকেন্দ্রিক। নানামুখী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এখানেই বড় হতে থাকে দলটি। স্বাধীনতার আগে-পরে কয়েকবার রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হলেও এর মধ্য দিয়েই দলটি কার্যক্রম চালিয়ে যায়। শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সিপিবির ভিত্তিও বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
প্রায় পৌনে এক শতক ধরে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে দলটি। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে-পরেও দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি ছিল সিপিবি। দীর্ঘ সময় নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকলেও অন্য দলগুলোর জন্য ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল সিপিবির সাংগঠনিক শক্তি ও প্রভাব। কালের বিবর্তনে দলটির পুরনো সে প্রভাব এখন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও এখন আর আগের মতো ঝড় তুলতে পারছে না দলটি। এজন্য সিপিবির সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই এখন বেশি দায়ী করা হচ্ছে।
যদিও গত কয়েক দশকে সিপিবির সদস্য সংখ্যা বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। দলটির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। ওই সময় দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৫০। সত্তরের দশকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দ্বিতীয় কংগ্রেসে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৭২৮-এ। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কংগ্রেসের সময় দলটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৭১২। সর্বশেষ চলতি বছর অনুষ্ঠিত সপ্তম কংগ্রেসের সময় এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৯৫৩-এ।
সদস্য সংখ্যা বাড়ার পরও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দলটির প্রভাবহীন হয়ে পড়ার নানামুখী কারণ চিহ্নিত করেছেন রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। তাদের এক পক্ষের ভাষ্যমতে, স্বাধীনতার পর ব্যাপক জনসাধারণের সামনে নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে হাজির হতে পারেনি দলটি। তেমন কোনো বড় আন্দোলন বা রাজনৈতিক কর্মসূচিও নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত বাকশালে যোগ দেয় দলটি। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর বাকশাল থেকে বেরিয়ে এলেও রাজনীতির ময়দানে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থানকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি সিপিবি। বরং প্রায়ই অন্যান্য দলের নেতৃত্বে বা জোটসঙ্গী হিসেবে নেয়া গৃহীত কর্মসূচিতেই দলটি সবচেয়ে বেশি সরব থেকেছে। এখনো নিজস্ব রাজনীতির পরিবর্তে নাগরিক নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আন্দোলনেই দলটিকে মাঠে নামতে দেখা যায় বেশি।
খোদ দলীয় কর্মীরাই এখন সিপিবির এখনকার পরিস্থিতির জন্য যথাযথ রাজনৈতিক কর্মসূচির অভাবকে দায়ী করছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলো টিকে থাকে জনগণের সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত আন্দোলন করার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সিপিবি অনেক পিছিয়ে আছে।
দলের গণসংগঠনে সক্রিয় এক কর্মী নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, রাজনীতিতে প্রতিনিয়ত জনসম্পৃক্ত বিষয়ে আন্দোলন করলেই কেবল দলের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ে। কিন্তু সিপিবি এখন শহরকেন্দ্রিক নির্দিষ্ট কিছু ইস্যুভিত্তিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরা গ্রামকেন্দ্রিক কার্যক্রম চালাতে পারছি না বা চালাতে চাচ্ছি না।
অনেকটা একই কথা বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দীন খানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো যেমন দুর্বল হয়েছে, সেটা আমাদের দেশে সিপিবির ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটেছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। ষাটের দশকে সিপিবি যেভাবে মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণের কথা চিন্তা করে কর্মসূচি নিত, সেটা সত্তরের মাঝামাঝি বা এর পর থেকে আর দেখিনি। তারা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যে ধরনের সম্পৃক্ততা তৈরি হওয়ার কথা, সেটি হয়নি। তাছাড়া আমাদের সামাজিক পরিমণ্ডলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছে। এর প্রভাব আমাদের রাজনীতি ও সমাজ ভাবনার মধ্যেও পড়েছে, যার ফলে সিপিবি পিছিয়ে গিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমার কাছে মনে হয় সিপিবির কর্মসূচিগুলো যতটা মানুষের প্রতি অঙ্গীকার থেকে নেয়া উচিত ছিল, তার চেয়েও বেশি নেয়া হয়েছে অন্য কোনো রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে। যে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মিলন ঘটেনি। এ কারণে সিপিবি আরো বেশি জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নিশ্চিতভাবে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে তাদের রাজনৈতিক সংকীর্ণতাও তৈরি হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে তারা যেকোনো সময়ের চেয়ে আরো বেশি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। এক্ষেত্রে সিপিবির উচিত সাধারণ মানুষের কাছে থাকা। তাদের কাছে রাখা। অনেক সময় দেখা যায়, ক্ষমতাসীনদের প্রতি সিপিবির একধরনের কোমল অবস্থান আছে। বিশেষ করে এখনকার ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সিপিবির অনেক ধরনের সখ্য আছে। কিংবা তাদের প্রতি সিপিবির যে কঠোর ভূমিকা রাখা উচিত, সে ভূমিকা রাখতে না পারার কারণে মানুষের আস্থাটাও কমেছে।
সিপিবির সদস্যপদ পেতে হলে কর্মীদের দলসংশ্লিষ্ট যেকোনো একটি গণসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। এছাড়া গ্রুপ সদস্য হিসেবে বিবেচিত কর্মীরা বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ের বিভিন্ন ধাপ পেরোনোর পরই দলের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পেয়ে থাকেন। এছাড়া সিপিবির একদল সহযোগী সদস্য রয়েছেন, যারা পূর্ণাঙ্গ সদস্য বা গ্রুপ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন না। ২০১২ সালের দশম কংগ্রেসের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় সিপিবির গ্রুপ সদস্য ছিল ৯ হাজার ৪১৭ জন। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৭-এ। সর্বশেষ কংগ্রেসে এ সংখ্যা কিছুটা বাড়ার তথ্য জানানো হলেও তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি।
গত কয়েক দশকে দলের সদস্য সংখ্যা বাড়লেও রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অবস্থা থেকে সিপিবি এখন অনেকটাই পিছিয়ে বলে অভিমত রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের। তাদের ভাষ্যমতে, ভাঙন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আন্দোলন বা দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয়ার মতো অবস্থান তৈরি করতে পারছে না দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির আগের কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। আমাদের কর্মী ঘাটতি রয়েছে। আমাদের শ্রমিক আন্দোলনও অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর একটি কারণ হলো আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা যায় মানুষের মধ্যে ভোগবাদিতা বৃদ্ধি। এতে মানুষের মাঝে স্বাভাবিক প্রবণতার পরিবর্তন হয়েছে। একই সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণীও তাদের হেজিমনি তৈরি করে রেখেছে। তাই আমরা আদর্শের লড়াইয়ে টিকতে পারছি না। তবে আমরা মশাল ধরে রাখছি সেটাই বেশি। আমাদের এখন পাল্টা হেজিমনি দাঁড় করাতে হবে। এটা করতে পারলেই আমরা ক্ষমতায় আসতে পারব।
সিপিবির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য এমএম আকাশ বলেন, আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য দুটো। একটি হলো স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং অংশীদারত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করা, যেখানে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে। যেখানে পেশি, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। এটি করার জন্য বিভিন্ন শ্রেণী যেমন কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ—তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নটা জরুরি। এটা পরস্পর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক সংগ্রাম যত অগ্রসর হবে, অর্থনৈতিক সংগ্রামও তত অগ্রসর হবে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন যত অগ্রসর হবে রাজনৈতিক সংগ্রামও তত অগ্রসর হবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সাম্যবাদ। সমাজতন্ত্র হলো সে পথ। সমাজতন্ত্রটা একেক দেশে একেকভাবে হবে। এ মুহূর্তে আমাদের বুর্জোয়া নয়, বিপ্লবী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা সব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে বিশ্বাস করি না। আমরা মিশ্র অর্থনীতিতে থাকব। যে খাতগুলো ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেলে সমাজে করপোরেট হাউজগুলোর আধিপত্য তৈরি হবে, সে অর্থনৈতিক ক্ষমতা আমরা দেব না। এগুলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে আধুনিকভাবে সুসংগঠিত করতে হবে। চীন, কিউবা বা ভিয়েতনামে যেভাবে ওরা রাষ্ট্রীয় মালিকানা সফল করেছে, সে দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করে বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে ও জনগণের নীতিনৈতিকতা বিবেচনা করে সেটাকে সংগতিপূর্ণ করতে হবে। সেজন্য সমাজতন্ত্রের কোনো ফিক্সড মডেলে আমরা বিশ্বাস করি না। সমাজতন্ত্র একেক দেশে একেক মাত্রায় হবে। মূলত এটা নির্ভর করবে শ্রেণীশক্তির ভারসাম্য আর অর্থনৈতিক বিকাশের স্তরের ওপর।
তিনি আরো বলেন, সিপিবির প্রভাব আগের চেয়ে কমেছে, সেটি অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু বামপন্থীদের মধ্যে সিপিবি এখনো সর্ববৃহৎ সংগঠন। যে প্রভাব কমেছে, সেটি হলো আগে সিপিবি যেকোনো ন্যায্য ইস্যুতে ঢাকাসহ যেকোনো বিভাগীয় শহরে পাঁচ হাজার মানুষের জমায়েত করতে পারত। এখন ঢাকা শহরেই পারে ১০০ থেকে ২০০। আর বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে আরো কম। সে অর্থে জনগণকে মোবিলাইজেশন ক্ষমতা সিপিবির কমে গিয়েছে। যদিও আপেক্ষিকভাবে সদস্য সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সদস্যের মানের দিকটি দেখতে হবে। আমাদের সংখ্যা বাড়লেও মান কমেছে। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে কাজ শুরুর সময় সদস্য ছিল ১২৮ জন। ওই একেকজন ছিল বর্তমানের এক হাজার জনের সমান। তারা শ্রেণীত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টি করেছিল। তখনকার আরেকটা সুবিধা ছিল, আমরা তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছি।
সিপিবিতে প্রথম বড় ধরনের ভাঙন ঘটে ষাটের দশকে। ওই সময় আন্তর্জাতিক মতাদর্শিক মহাবিতর্কের জেরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মতো সিপিবিও বিভক্ত হয়ে পড়ে। ওই ভাঙন দলটিকে বেশ বিপাকে ফেলে দিয়েছিল। সিপিবির কংগ্রেস প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দলের গ্রুপগুলো প্রত্যাশামাফিক কার্যক্রম চালাতে পারেনি। তবে মণি সিংহ ও মোহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে এর মধ্যেও দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক মাত্রায় সক্রিয়তা ধরে রাখে সিপিবি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনাগুলোয় বড় অবদান রাখতে সক্ষম হয় দলটি।
তবে সিপিবির জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত হয়ে দেখা দেয় নব্বইয়ের দশকের ভাঙন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯৩ সালে মস্কোপন্থী দল সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় ৭৫ জনের মধ্যে ৬০ জনই দল ছেড়ে চলে যায়। দলের সঙ্গে ছিলেন ১৪ জন। সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক সিপিবি ছেড়ে যোগ দেন গণফোরামে। সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাহিদও দল ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকে সংঘটিত ওই ভাঙনের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সিপিবি। এর পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে আন্দোলন বা দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয়ার মতো জায়গায়ও আর যেতে পারেনি দলটি। এ ভাঙনের পর ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসেও দলটির পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেয়া হয়, সিপিবির পার্টি গ্রুপ সংগঠিত করার কাজ বলতে গেলে প্রায় কিছুই এগোয়নি। তবে এর আগেও দলটি কিছু সাংগঠনিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত দলটির পঞ্চম কংগ্রেসের সাংগঠনিক রিপোর্টে বলা হয়, চতুর্থ কংগ্রেসে পার্টি সংগঠনকে গণভিত্তিক, শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্যে যে কর্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল, আকাঙ্ক্ষানুযায়ী তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। চতুর্থ কংগ্রেসের পর সদস্য সংখ্যা বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। প্রার্থী সদস্য সংখ্যা কমেছে ২০ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, সদস্য সংখ্যা দিয়ে সিপিবির প্রভাব পরিমাপ করা যাবে না। কারণ দলগুলো আগে যেসব বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে বিবেচনা করত, সেগুলো এখন আরো শিথিল করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমাদের এখানে সিপিবির ভাঙন হয়েছে এবং দলের গ্ল্যামারাস নেতারা চলে গিয়েছে। এ কথা শুধু সিপিবি না, সারা দুনিয়ার বামদের জন্য প্রযোজ্য। আমরাও এখন পুঁজিবাদের রাজনৈতিক প্রকল্প গণতন্ত্রের পূজারি। আগে বৈশ্বিক একটা হাওয়া ছিল। সে সময়ে সমাজতন্ত্রের মধ্যেই অনেক মানুষ মুক্তি খুঁজত। এ প্রজন্মের অভিভাবক, ছেলে-মেয়েরা এভাবে ভাবে না। আর সিপিবির দুর্বলতা বলতে আমার কাছে মনে হয়, আগের সেই উদ্যম, সংগঠনে ভাটা আছে। হয়তো দলটির চলতি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তরুণদের সামনে উপস্থাপিত হওয়ার ব্যাপারে সমস্যা আছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় নিজেদের উপস্থাপন করার ব্যাপারে দৃশ্যমান দুর্বলতা লক্ষ করা গিয়েছে। দলটি তেমন মিডিয়া কাভারেজও পায় না।
নব্বইয়ের দশকের ভাঙনের ধাক্কা কাটিয়ে এখনো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি সিপিবি। দলের কোনো কোনো নেতা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নকেও সিপিবির বিকাশের পথে বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সিপিবির এক সদস্য বলেন, এখন আবার রাজনীতিতে নতুন সংস্কৃতি যোগ হয়েছে। যেমন গুম করে ফেলছে, ধরে নিয়ে যাচ্ছে, গুলি খেতে হচ্ছে। কিছুুদিন আগেই তো ভোলায় দুজন ছাত্রদলের নেতাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।
তবে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো বেশ আশাবাদী কেন্দ্রীয় নেতারা। সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. মনোজ দাশ এ বিষয়ে বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে আত্মনির্ভর, দুর্নীতিমুক্ত, জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, গ্রাম অভিমুখী বৈষম্যমুক্ত, লুটপাটমুক্ত একটি জাতীয় বিকাশের অর্থনীতি গড়ে তোলা। আর রাজনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর করা। সিপিবি আশির দশকে যে ভূমিকা রাখতে পারত, এখন সেটা পারছে না। তবে সিপিবিতে এখন গুণগত পরিবর্তন আসছে। সিপিবি এখন বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সে কাজটি খুবই কঠিন। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর কাজটি একটু কঠিন হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি সিপিবির কর্মীরা সেই কাজটা ধীরস্থির ও ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছে। আমি মনে করি সিপিবিতে কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত একটা নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, যারা মতাদর্শিকভাবে খুবই উন্নত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ মুহূর্তে সিপিবির যে সক্ষমতা নেই বলে মনে হচ্ছে, তা কেটে যাবে। কারণ এ প্রজন্ম দায়িত্বটা কাঁধে নিয়ে এগিয়ে আসবে। আমার মনে হয় এখন সিপিবিসহ সব রাজনৈতিক দলের কর্তব্য হচ্ছে ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ভোটের অধিকার যদি আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ের দাবিকে জোরদার করা। সেটি করলেই আমাদের সমাজে মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সিপিবি যতটুকু প্রভাব বিস্তার করা দরকার হয়তো ততটুকু পারছে না। তার পরও সিপিবি জনগণের কাছে প্রভাব বিস্তারকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে আমি মনে করি। ষাট-সত্তরের দশকে শত্রু-মিত্র চেনা বা মানুষকে চেনানো সহজ ছিল। এখন ঘরের মধ্যে শত্রু, সেটি চেনানো কঠিন। যেমন ধরুন আগে বাঙালি-আদিবাসী এক পক্ষ ছিলাম। আমাদের শত্রু হিসেবে মনে হতো বিদেশী বা পশ্চিমারা। কিন্তু এখন বাঙালিদের মধ্যেই শোষক-শোষিত দুই পক্ষই আছে। ভোটের বিবেচনায় যারা এগিয়ে আছে তাদের ওপরও এদের প্রভাব আছে। এটি একটি কারণ। দ্বিতীয়ত, সমাজ বাস্তবতাসহ নানা কারণে এখন মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা সহজ নয়। তৃতীয়ত, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এখন একেবারেই উল্টো স্রোতে সিপিবিকে চলতে হচ্ছে। এ রকম একটি জায়গা থেকে মানুষের মধ্যে বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা একটু সময়ের ব্যাপার। সে জায়গাটায় আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছি। আশা করি, সেই জায়গা আমরা রিকভার করতে পারব এবং আস্থাভাজন শক্তি হিসেবে সংগ্রাম করব।