দৈনিক বনিক বার্তা
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ। স্বাধীনতার আগে থেকেই এটি ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন অংশের নির্বাচনী প্রতীক। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করেছে ন্যাপ (ভাসানী)। মওলানা ভাসানী প্রতীকটিকে ।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ। স্বাধীনতার আগে থেকেই এটি ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন অংশের নির্বাচনী প্রতীক। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করেছে ন্যাপ (ভাসানী)। মওলানা ভাসানী প্রতীকটিকে বেছে নিয়েছিলেন কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার আপামর জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে। তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ও রাজনীতি প্রতীকটির গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি করেছিল।
মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাপের তত্কালীন মহাসচিব মশিউর রহমান যাদু মিয়াসহ তার অনেক রাজনৈতিক শিষ্য ও সহযোগী যোগ দেন বিএনপিতে। সঙ্গে করে নিয়ে যান দলের প্রতীক ধানের শীষকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধানের শীষ প্রতীকটি এখন বিএনপিরই সমার্থক হয়ে উঠেছে। প্রতীকটির রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মওলানা ভাসানী বা তার রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা এখন শোনা যায় কালেভদ্রে।
বিএনপির সুসময়-দুঃসময়ের কাণ্ডারিদের অনেকেই একসময় ছিলেন মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী। বিশেষ করে দলটির সর্বশেষ তিন মহাসচিবই মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন দীর্ঘদিন। তাদেরই একজন দলটির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। টানা ১১ বছর দলটির মহাসচিব ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার আগে ছাত্র ইউনিয়নের ভাসানী অনুসারী অংশটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ডাকসুর সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ করে যোগ দেন ন্যাপের (ভাসানী) রাজনীতিতে। ওই দলের সদস্য হিসেবেই ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছেন তিনি। এছাড়া তিনি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাপের রাজনীতি ছেড়ে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি নামে একটি দলের রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। বিএনপিতে যোগ দেন ১৯৮০ সালে। সাড়ে আট বছর যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করার পর বিএনপির মহাসচিব হন ১৯৯৬ সালে। ওই সময় বিরোধী দল বিএনপির কার্যক্রম ও কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করেছেন তিনি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বহিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেছেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া।
দলটির মহাসচিব পদে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার উত্তরসূরি খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মওলানা ভাসানীর ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন ১৯৫৭ সাল থেকে। ১৯৭৮ সালে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। দলের মহাসচিব হন ২০০৭ সালে। ২০১১ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদে ছিলেন তিনি।
খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব পান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছাত্রজীবন থেকেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী ছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে সক্রিয় হন বিএনপির রাজনীতিতে। বিএনপির রাজনীতিতে মওলানা ভাসানী ও তার অনুসারীদের অবদান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীকে মূল্যায়ন করার খুব বেশি যোগ্যতা আমার নেই, কারণ ভাসানী অনেক উঁচু দরের নেতা। তার রাজনীতিই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সাধারণ মানুষের জন্য, তাদের অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য, সমাজকে পাল্টে দেয়ার জন্য রাজনীতি করতেন তিনি। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক একজন নেতা। তিনি ধনীদের দ্বারা গরিবের শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং সাম্যের পক্ষে ছিলেন।
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শ এখনো বিএনপিতে সজীব আছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, মওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রধান বিষয়বস্তু ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য তিনি রাজনীতি করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর মশিউর রহমান জাদু মিয়া ন্যাপের নেতৃত্বে আসেন। সে সময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি ফ্রন্ট গঠন হয়েছিল। সে ফ্রন্টে যাদু মিয়া ন্যাপকে নিয়েছিলেন। সেটি যখন দলে রূপান্তরিত হয় তখন তিনি একটি বিশেষ কাউন্সিল করে বিএনপির সঙ্গে একীভূত হন। আমার মনে হয় তখন তিনি এটি সঠিকভাবেই করেছিলেন। কারণ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে মশিউর রহমান যাদু মিয়া অথবা ন্যাপের রাজনীতির খুব বেশি পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা মনে করেছিলেন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে তারা তাদের আদর্শগুলো অর্জনের পাশাপাশি জনগণের জন্য উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারবেন। তখন ন্যাপের অনেক মানুষ বিএনপিতে নেতৃত্বের দিকেই চলে এসেছিলেন। যেমন উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন এসএ বারী সাহেব, মন্ত্রী ছিলেন রহমান সাহেব ও ইমরান আলী সরকার। এ রকম বহু নেতা বিভিন্ন পর্যায়ে বিএনপির নেতা হয়েছিলেন। কারণ ফ্রন্ট থেকেই বিএনপি তৈরি হয়েছিল। সে কারণে তারাও নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
মওলানা ভাসানীর রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে প্রধানত গ্রামীণ কৃষকদের কেন্দ্র করে। দেশের মূলধারার রাজনীতিকে জমিদার ও সামন্ত শ্রেণীর বৈঠকখানা থেকে নিম্নবিত্ত কৃষকদের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার করে তুলেছিলেন তিনি। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ কর্মসূচিও ছিল কৃষকদের স্বার্থকেন্দ্রিক। তার ‘ভাসানী’ নামের উত্পত্তিও হয়েছে কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে। আসামের ধুবড়ি জেলায় ব্রহ্মপুত্রের ভাসান চরে ১৯২৯ সালে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন তিনি। সেখান থেকেই প্রথম ‘ভাসানীর মওলানা’ নামে পরিচিত হন তিনি। একপর্যায়ে এ ‘ভাসানী’ শব্দটিই তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
তার অনুসারীদের বড় একটি অংশ পরে বিএনপিতে যোগ দিলেও সেখানে মওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রভাব দেখা গেছে তুলনামূলক কম। এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য হলো শুরুতে খাল কাটাসহ কৃষিকেন্দ্রিক কর্মসূচি হাতে নিলেও পরে দলটিতে আর এ ধরনের বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এর পরিবর্তে দলটির রাজনীতিতে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এছাড়া পরে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক এলিটরাই দলটিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে উঠেছিলেন।
তবে তাদের এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত নন বিএনপিতে যোগদানকারী ভাসানী অনুসারীরা। তাদের বক্তব্য হলো দলটি এখনো মওলানা ভাসানীর আদর্শকেই লালন করছে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতা সাম্প্রতিক কয়েকটি অনুষ্ঠানে এমন বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
ব্রিটিশ আমলে টাঙ্গাইলের সন্তোষ, সিরাজগঞ্জ ও গাইবান্ধায় অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলন মওলানা ভাসানীকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় পূর্ব বাংলার প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সর্বসম্মতিক্রমে দলের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রধান শরিক ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ওই বছরেই পাকিস্তানের তত্কালীন কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করে। মওলানা ভাসানী তখন বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য সুইডেনের স্টকহোমে অবস্থান করেন। সে সময় পাকিস্তান সরকার মওলানা ভাসানীর দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রায় এক বছর পর দেশে ফেরার সুযোগ পান তিনি। ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে তহবিলের দাবিতে তিনি অনশন ধর্মঘট করেন। ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। সে সময় পররাষ্ট্রনীতি বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করেন তিনি। ন্যাপ গঠনের পর পরই প্রকাশ্যে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মওলানা ভাসানী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও তিনি ও ন্যাপ বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭০ সালে ঢাকার পল্টনে এক জনসভায় প্রথমবারের মতো ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের’ সপক্ষে বক্তব্য রাখেন মওলানা ভাসানী। স্বাধীনতার সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে তার উদ্যোগে প্রকাশিত হতে থাকে ‘সাপ্তাহিক হক-কথা’। ১৯৭৬ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক এক লংমার্চে নেতৃত্ব দেন তিনি।
ওই লংমার্চের প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া। ১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের অনেক আগে থেকেই মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তিনি। কোনো সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে মওলানা ভাসানী যেতে অপারগ হলে তার প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকতেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া। ভাসানীর মৃত্যুর পর দল পরিচালনার দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তায়। যদিও দলের অন্য অনেক নেতাকর্মীকে নিয়ে তিনি যুক্ত হন বিএনপির গঠন প্রক্রিয়ায়। দলটির গঠন প্রক্রিয়াকালীন আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে বিএনপি থেকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া।
ন্যাপ (ভাসানী) বিএনপিতে বিলীন হয়ে পড়ার মূল কারিগর হিসেবে পরিচিত মশিউর রহমান যাদু মিয়া। পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতিতে ন্যাপ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার জন্যও বিশেষ করে তাকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন মওলানা ভাসানীর পরিবারের সদস্যরা। তার পৌত্র পরশ ভাসানীর মতে, মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাপের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল মশিউর রহমান যাদু মিয়া ন্যাপ থেকে বিএনপি জোটে যোগ দেয়া।
তিনি বলেন, ন্যাপকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে যাদু মিয়া বিএনপিতে যোগ দেন। যেহেতু দলের মহাসচিবই দলকে বিএনপির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন, সেহেতু দলের অন্য সদস্যরাও দল ছেড়ে গেলেন। পরে ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ন্যাপ নামে নামসর্বস্ব ১৫-১৬টি দল হয়েছে। সবগুলোই ছিল ‘ওয়ান ম্যান, ওয়ান পার্টি’ হিসেবে। ১৯৯১ সালে মওলানা ভাসানীর স্ত্রী আলেমা খাতুন ন্যাপ নাম দিয়ে পরিচালনাধীন সব দলকে ডেকেছিলেন। কিন্তু তারা কেউই একে অন্যকে মানতে চায়নি। ফলে তাদের আর একই ছাতার নিচে আসা সম্ভব হয়নি।
মওলানা ভাসানীর রাজনীতির মূলধারাটি এখন একেবারেই বিলীন হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ন্যাপের যে অংশ নিবুনিবু করে টিকে ছিল, সেটি আলেমা খাতুন ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৯১ ও ১৯৯৬-এর নির্বাচনে অংশ নেয়। পরে আর কোনো নির্বাচনে দলটি অংশ নেয়নি। আমার মতে বর্তমানে রাজনীতিতে ভাসানীর মূলধারাটি একেবারেই নেই। যেটি বিএনপিতে যোগ দিয়েই শেষ হয়ে যায়।
ন্যাপের (ভাসানী) তত্কালীন সদস্যদের সিংহভাগই বিএনপি গঠনের সময়ে দলটিতে চলে যায় উল্লেখ করে মজলুম জননেতার ব্যক্তিগত সচিব ও হক-কথার সাবেক সম্পাদক ইরফানুল বারী বণিক বার্তাকে বলেন, মওলানা ভাসানী মারা যাওয়ার পরেই ন্যাপ ভেঙে যায়। তখন ন্যাপের সত্তর থেকে পঁচাত্তর শতাংশ সদস্য বিএনপিতে যোগ দেন। অর্থাৎ সিংহভাগই দলত্যাগ করেন। ন্যাপের সঙ্গে সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত ও তার অন্য অনুসারীরাও বিএনপিতে যোগ দেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া, যাদু মিয়ার মেয়ে রিটা রহমান, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, তরিকুল ইসলাম, এসএ বারী, নুরুর রহমান প্রমুখ।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ছিলেন মওলানা ভাসানীর দীর্ঘদিনের সহচরদের একজন। জাতীয় সংসদের সাবেক এ স্পিকার বিএনপি আমলে কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ১৯৪৫ সাল থেকে। বিএনপি গঠনের প্রথম পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাগদলে যোগ দেন তিনি।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়কদের আরেকজন ছিলেন মওলানা ভাসানীর সহযোগী রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম। পরে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দলটির নেতৃত্বে গঠিত সরকারের মন্ত্রীও হয়েছেন দুই দফায়। এছাড়া দলের যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। ১৯৭০ সাল থেকে ন্যাপের সদস্য হিসেবে মওলানা ভাসানীর সহযোগী হিসেবে ছিলেন প্রয়াত এ রাজনীতিবিদ।
তার ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত এখন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার দাবি, মওলানা ভাসানীর যারা শিষ্য ছিলেন, সহকর্মী ছিলেন তাদের তিনি নিজেই বলেছিলেন—তোমরা যদি রাজনীতি করতে চাও, তবে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করো। কারণ তার মধ্যে দেশপ্রেম আছে, সততা আছে। এ সবকিছু মিলিয়ে মওলানা ভাসানী উৎসাহ দিয়েছিলেন। বিএনপি গঠনের আগে ছয়টি দল নিয়ে একটি ফ্রন্ট হয়। সে ফ্রন্ট থেকে দল হয়। তখন বিভিন্ন জেলা-উপজেলার যারা প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক ছিলেন বা প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন; তারা হয় ভাসানীর ন্যাপ করেছেন, নয়তো ছাত্র ইউনিয়ন করে আসা ছিলেন। কারণ তারা জিয়াউর রহমানের মধ্যে মওলানা ভাসানীর অনেক কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন। সুতরাং তাদের মধ্যে আমি এ নিয়ে কোনো অস্বস্তি দেখিনি বা তাদের কথাবার্তায়ও এ নিয়ে কোনো হতাশা ছিল না।
তিনি আরো বলেন, বিএনপি ন্যাপের আদর্শ ধারণ করছে, ব্যাপারটা এ রকম নয়। জিয়াউর রহমান যে উনিশ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন, সে দফাগুলোর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর রাজনীতির মিল পেয়েছেন তার অনুসারীরা। আমার বাবা ও অন্যরা যখন দলটিতে আসেন উনাদের বয়স তখন কম। এখন খুলনা অঞ্চলে বিএনপির জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক-সভাপতিদের একটা বৃহৎ অংশ মওলানা ভাসানীর ন্যাপ করে এসেছিলেন। জিয়াউর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন দেশ গঠন করতে গেলে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ লাগবে। তত্কালীন ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন করে আসা লোকেরা ছিলেন অনেক মেধাবী। জিয়াউর রহমান তাদের কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এখানে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এসেছিল। শুধু যে ভাসানীর ন্যাপ থেকে এসেছিল, এমন নয়। এখানে হয়তো একটা বৃহৎ অংশ ভাসানীর ন্যাপ থেকে এসেছিলেন; তবে অন্যান্য মত-পথের মানুষেরও সম্মিলন ঘটেছিল।
ন্যাপ ভাসানী বিলীন হয়ে পড়ার পেছনে মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে দায়ী করতে নারাজ তার মেয়ে রিটা রহমান। বর্তমানে বিএনপির সদস্য এ রাজনীতিবিদ বলেন, যাদু মিয়ার মাধ্যমে ন্যাপ বিএনপিতে মার্জ করেনি। বরং কার্যক্রম সাসপেন্ড রেখেছিল। এবং তখন বলা হয়েছিল যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে দরকার হলে ন্যাপ মার্জ করবে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মশিউর রহমানের; মানে আমার বাবার একটি চুক্তি হয়। চুক্তিটির শিরোনাম ছিল গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া। এ চুক্তির পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। ওই সময় পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল যে সৈনিকরা অনেকগুলো ক্যু সংঘটিত করছিল। এর সঙ্গে মাত্র কয়েক বছর আগে স্বাধীন দেশটিকে নিয়ে অনেকের নানা অপচিন্তাও ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের পয়লা মে জাতীয়তাবাদী জোট গঠন করা হয়। ছয়টি দল মিলে এই জোট গঠন করা হয়। দলগুলো হলো জাস্টিস আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানের জাগদল, মশিউর রহমানের নেতৃত্বে ন্যাপ (ভাসানী), শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ, ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি), মাওলানা আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি এবং রসরাজ মন্ডলের নেতৃত্বে তাফসীল জাতীয় ফেডারেশন। পরবর্তী সময়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি পায় ২০৬টি আসন, যার মধ্যে ৭৯টি আসন পায় ন্যাপ। বাই ইলেকশনসহ সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯২টিতে। ন্যাপ বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয়েছে মূলত আমার বাবার মৃত্যুর পরে।